২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় পরীক্ষা কেন্দ্রের ভেতরে আলিম পরীক্ষার্থী ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল নৃশংস এ হত্যাকাণ্ড। গত বছরের এদিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসকদের সব রকমের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে চিরবিদায় নেন নুসরাত জাহান রাফি।
ওই বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার নিজ অফিস কক্ষে ডেকে রাফিকে যৌন হয়রানি করেন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেছিলেন নুসরাতের মা শিরিন আখতার। ওইদিনই স্থানীয়দের সহায়তায় অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর সিরাজকে জেল থেকে বের করে আনার জন্য ও মামলা তুলে নিতে তার অনুগতরা নুসরাত রাফি ও তার পরিবারকে নানাভাবে চাপ দিতে থাকে।
৬ এপ্রিল পরীক্ষা দিতে গেলে সিরাজের লোকজন নুসরাতকে মাদরাসার সাইক্নোন শেল্টারে ছাদে ডেকে নেয়। মামলা তুলে নিতে চাপ দিলে সে অস্বীকার করে। এসময় হাত-পা বেঁধে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সন্ত্রাসীরা সরে পড়ে। তার চিৎকারে ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। এরপর তাকে স্থানান্তর করা হয় ফেনী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় সেখান থেকে নুসরাতকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে।
বর্বরোচিত এ ঘটনা বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। পরিকল্পিত এ হত্যাকাণ্ডটিকে শুরু থেকে আত্মহত্যা বলে চালাতে চান থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মামলাটি পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়। গণমাধ্যমের দৃঢ় অবস্থান এবং পিবিআইর তদন্তে প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসতে থাকে। এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্তে দোষীসাব্যস্ত হওয়ায় এসপি জাহাঙ্গীর ও ওসি মোয়াজ্জেমসহ ৪ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়।
অপরদিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল রাত ৯টায় নুসরাত রাফি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। হাসপাতালের বিছানায় জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকেও নুসরাত বিচার চেয়েছিল। এর আগে যৌন হয়রানির পরও ডায়েরিতে সে বান্ধবীদের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে যায়। যা ঘটনার রহস্য উদঘাটনে কাজে আসে।
এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় ২৮ মে অভিযোগপত্র দাখিলের পর ২০ জুন অভিযোগ গঠন করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। পরে সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষে ৩০ সেপ্টেম্বর আদালত রায়ের জন্য ২৪ অক্টোবর নির্ধারণ করেন। মামলাটিতে মাত্র ৬১ কার্যদিবসে ৮৭ সাক্ষির সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্ততর্ক গ্রহণ করা হয়। একই বছরের ২৪ অক্টোবর মামলার অভিযোগপত্রে অর্ন্তভুক্ত ১৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। বাদী পক্ষের আইনজীবী শাহজাহান সাজু বলেন, এটি দেশের বিচারাঙ্গনে নজিরবিহীন।
পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড করেন। দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার তৎকালীন অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ-দৌলা (৫৭), উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও মাদরাসা গভর্নিং কমিটির তৎকালীন সহ সভাপতি রুহুল আমিন, মাদরাসা শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম (৫০), নু উদ্দিন, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), প্রভাষক আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা পপি (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন মামুন (২২), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীম (২০)।
২৯ অক্টোবর আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) মামলার যাবতীয় কার্যক্রম হাইকোর্টে পৌঁছে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ হলে অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়। সে অনুসারে ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক (মামলার যাবতীয় নথি) ছাপানো শেষ করা হয়েছিল। পরে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে শুনানির জন্য মামলাটি প্রধান বিচারপতি বরাবর উপস্থাপন করা হয়। আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করেছেন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতি সৌমেন্দ্র সরকারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ মামলার শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদিকে নুসরাত রাফির পরিবারের সদস্যরা এখনো শংকার মধ্যে রয়েছেন। মা শিরিন আখতার বলেন, একজনকে গ্রেপ্তারের জের ধরে তার মেয়েকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এখন তো ১৬ জন। দণ্ডপ্রাপ্তদের লোকজন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে আপত্তিকর মন্তব্যসহ নানাভাবে তাদের হুমকি ধমকি দিয়ে আসছে। তবে ঘটনার পর থেকেই তাদের বাড়িতে পুলিশি পাহাড়া রয়েছে। তিনি দ্রুত ফাঁসির রায় বাস্তবায়নের জন্য সরকারের নিকট দাবি জানান।
বার্তা প্রধান ।
বাংলা নিউজ টিভি।